সম্পদ আকারে দেশের সবচেয়ে বড় বেসরকারি ঋণদাতা ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড (আইবিবিএল) এখন দেশের ব্যাংকিং ইতিহাসের অন্যতম বৃহৎ প্রভিশন ঘাটতির মুখোমুখি। ২০২৫ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ব্যাংকটির প্রভিশন ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৮৫ হাজার ৮৮৮ কোটি টাকা। ব্যাংকটির আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ ব্যাংক এই ঘাটতি কাটিয়ে উঠতে ২০ বছরের ডেফারাল সুবিধা অনুমোদন করেছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মুনাফা দিয়ে এই ঘাটতি পূরণ করা প্রায় অসম্ভব। ইসলামী ব্যাংক গত কয়েক বছর ধরে গড়ে প্রতি বছর প্রায় ৬০০ কোটি টাকা নিট মুনাফা অর্জন করেছে। এই লাভের পুরোটা প্রভিশনে ব্যয় করলেও ঘাটতি পূরণে সময় লাগবে প্রায় ১৪৩ বছর—যা একটি ব্যাংকের স্বাভাবিক ব্যবসায়িক চক্রের সঙ্গে কোনোভাবেই সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।
এ বছরের প্রথম ৯ মাসে ব্যাংকের সমন্বিত নিট মুনাফা ছিল মাত্র ৯৯.৭৭ কোটি টাকা। এই পারফরম্যান্স একইভাবে বজায় থাকলে পুরো বছরে সম্ভাব্য লাভ দাঁড়াবে প্রায় ১৩৩ কোটি টাকা। সেই হিসাবে বর্তমান মুনাফার গতিতে ঘাটতি পুষিয়ে উঠতে লাগবে প্রায় ৬৪৫ বছর, যা যেকোনো আর্থিক প্রতিষ্ঠানের জন্য অকল্পনীয় চিত্র।
অত্যন্ত আশাবাদী হিসাব ধরলেও—যেখানে ব্যাংকের মুনাফা প্রতিবছর ১৫ শতাংশ যৌগিক হারে (compound rate) বাড়বে—তবুও প্রভিশন ঘাটতি পুষিয়ে উঠতে সময় লাগবে অন্তত ৩৫ বছর। অর্থনীতিবিদদের মতে, দীর্ঘ সময় ধরে এমন প্রবৃদ্ধি ধরে রাখা বাস্তবে খুবই কঠিন, বিশেষ করে যখন ব্যাংকের অর্ধেকের বেশি বিনিয়োগ এখন শ্রেণিকৃত (classified) হিসেবেই বিবেচিত।
ব্যাংকের সবচেয়ে বড় ঋণগ্রহীতা এস আলম গ্রুপ থেকে অর্থ উদ্ধার করাই এখন আইবিবিএলের প্রধান চ্যালেঞ্জ। ব্যাংকটি ইতোমধ্যে গ্রুপের প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকার সমমূল্যের সম্পদ জব্দ করেছে। কিন্তু এসব সম্পদের নিলামে ক্রেতা পাওয়া যাচ্ছে না, ফলে পুনরুদ্ধারের সম্ভাবনা আরও দুর্বল হয়ে পড়ছে।
ব্যাংকের হিসাবে দেখা যাচ্ছে, এস আলম সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো ইসলামী ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছে ৭৩ হাজার কোটি টাকার বেশি, যার বিপরীতে জামানত রয়েছে মাত্র ৪ হাজার ৩৫৯ কোটি টাকা। অর্থাৎ প্রতি ১৭ টাকা ঋণের বিপরীতে জামানত রয়েছে মাত্র ১ টাকার।
এস আলম গ্রুপকে দেওয়া ঋণের প্রক্রিয়ায় ভয়াবহ অনিয়মের তথ্যও সামনে এসেছে। উদাহরণ হিসেবে সিলভার ফুড ইন্ডাস্ট্রিজ নামের লোকসানী একটি আটা কল মাত্র ১৮ কোটি টাকায় কেনার পর পরের বছরই ইসলামী ব্যাংক ওই প্রতিষ্ঠানের নামে অনুমোদন দেয় ৮৫০ কোটি টাকা ঋণ, যা পরে বেড়ে দাঁড়ায় ১ হাজার কোটি টাকারও বেশি। ব্যাংকিং নীতিমালার এই ধরনের ধারাবাহিক লঙ্ঘন এখন আইবিবিএল-এর প্রভিশন ঘাটতির অন্যতম বড় কারণ হিসেবে চিহ্নিত হচ্ছে।
এদিকে দুদক ব্যাংক থেকে ১০ হাজার ৫০০ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে এস আলম গ্রুপের চেয়ারম্যানসহ ৬৭ জনের বিরুদ্ধে মামলা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। মামলার অগ্রগতি, সম্পদ পুনরুদ্ধারের সক্ষমতা এবং ব্যাংকের পুনর্গঠন পরিকল্পনা—সব মিলিয়ে ইসলামী ব্যাংকের ভবিষ্যৎ এখন কঠিন অনিশ্চয়তার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে।



Leave a Reply