শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত জেনেক্স ইনফোসিস জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) অধীনে দেশব্যাপী ইএফডিএমএস স্থাপন, খুচরা ও ব্যবসায় পর্যায়ে অনলাইনভিত্তিক মূসক আহরণ ব্যবস্থা চালু করার একটি বড় কাজ পায়। এই বিষয়ে সংবেদনশীল তথ্য হিসাবে স্টক এক্সচেঞ্জে প্রচার করে শেয়ার দাম বাড়িয়ে কোম্পানিটির পরিচালকরা বিশাল ফায়দা লুটে নেয়। বর্তমানে এনবিআর-এর ওই কাজ নিয়ে কোম্পানিটির বিরুদ্ধে বহু জালিয়াতির অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে।
ইএফডি মেশিন ও এসডিসি স্থাপনে জেনেক্স ইনফোসিস লিমিটেডের এমন অনেক অনিয়ম পেয়েছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) গঠিত তদন্ত কমিটি। সম্প্রতি কমিটি এই বিষয়ে একটি প্রতিবেদন দিয়েছে।
এনবিআর সূত্রে জানা গেছে, ‘জেনেক্স ইনফোসিস লিমিটেডের ফাংশনাল কার্যক্রম পরীক্ষা’ করে প্রতিবেদন দিতে চলতি বছরের ২৫ এপ্রিল সাত সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়। এনবিআরের গবেষণা ও পরিসংখ্যানের মহাপরিচালক মুহাম্মদ রাশেদুল আলমকে আহ্বায়ক ও ঢাকা উত্তর ভ্যাট কমিশনারেটের অতিরিক্ত কমিশনার মোহাম্মদ মসিউর রহমানকে সদস্য সচিব করা হয়।
কমিটি গঠনের বিষয়ে বলা হয়, দেশব্যাপী ইএফডিএমএস স্থাপন, খুচরা ও ব্যবসায় পর্যায়ে অনলাইনভিত্তিক মূসক আহরণ ব্যবস্থা চালু করতে এনবিআর প্রতিযোগিতামূলক টেন্ডার প্রক্রিয়ার মাধ্যমে জেনেক্স ইনফোসিস লিমিটেডের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়। চুক্তির শর্তাবলি ও চুক্তির লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী ভেন্ডর প্রতিষ্ঠান জেনেক্সের ফাংশনাল কার্যক্রমের বর্তমান অগ্রগতি যথাযথভাবে ধারাবাহিক ও সামসঞ্জ্যপূর্ণ রয়েছে কি না, তা পরীক্ষণ ও পর্যালোচনা করে বাস্তবসম্মত প্রতিবেদন তৈরি করতে এই কমিটি করা হয়।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মেশিন বসবে ৬০ হাজার, বসেছে ১১ হাজার। চুক্তি অনুযায়ী মেশিন বসানোর লক্ষ্যমাত্রার কাছাকাছিও যায়নি। চুক্তির শর্ত ছিল-প্রত্যেক জোনে (ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ কমিশনারেট, চট্টগ্রাম কমিশনারেট) ২০ হাজার করে প্রথম বছরে ৬০ হাজার ইএফডি ও এসডিসি স্থাপন করা। ২০২৩ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে ৩০ হাজার ও ২০২৪ সালের জুনের মধ্যে ৬০ হাজার বসানোর কথা। সে অনুযায়ী মেশিন বসানোর একটি প্রাথমিক ম্যাপিং করে জেনেক্স।
কমিটি যাচাই করে দেখেছে, জেনেক্স ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ১৪ হাজার ২৪৮টি মেশিন বসানো হয়েছে বলে এনবিআরকে তথ্য দিয়েছে। যদিও বিভিন্ন কমিশনারেট থেকে ভেন্ডরকে ৪২ হাজার ২৩৫টি বিআইএন বা প্রতিষ্ঠানের তথ্য সরবরাহ করেছে এনবিআর।
কিন্তু চলতি বছরের মে পর্যন্ত মেশিন বসেছে ১১ হাজার ৩১৩টি। বাকি চার হাজার ৬৬২টি মেশিন প্রতিষ্ঠানের কাছে অবশিষ্ট রয়েছে। জেনেক্স ১৯৫টি এসডিসি স্থাপনের দাবি করলেও প্রকৃতপক্ষে এসডিসি স্থাপন হয়েছে ৯৭টি। সাত হাজার ৯৫৮টি এসডিসি মেশিন স্টকে জমা থাকলেও এপিআই-সংক্রান্ত জটিলতায় তা বসানো সম্ভব হয়নি। মেশিন স্থাপনের হার বর্তমান সময় পর্যন্ত মাত্র ১৯ শতাংশ। বর্তমান গতিতে মেশিন স্থাপন করা হলে কোনোভাবেই সফলতা আসবে না।
সিস্টেম পর্যালোচনায় দেখা গেছে, সিস্টেমে প্রদর্শিত মেশিনের সংখ্যার সঙ্গে বাস্তবে স্থাপিত মেশিনের সংখ্যার মিল নেই। বাস্তবে কম মেশিন স্থাপিত হলেও সিস্টেমে বেশি মেশিন দেখিয়েছে জেনেক্স। মেশিন ব্যবহার-সংক্রান্ত বেশ কিছু সমস্যা পাওয়া গেছে। যেমন মেশিনগুলো রিয়েল টাইম ডেটা প্রদর্শন করে না। স্থাপিত মেশিনের সঙ্গে সার্ভার সংযোগ নিয়মিত রাখার ক্ষেত্রে নেটওয়ার্কের সমস্যা রয়েছে। ড্যাশবোর্ড ইউজার ফ্রেন্ডলি নয়। মেশিন বিকল হলেও সচল করতে বিলম্ব হয়ন। অর্থাৎ চুক্তির শর্তানুযায়ী যে কনফিগারেশনের মেশিন দেয়ার কথা, তা দেয়া হয়নি।
এনবিআর বলছে, চুক্তি অনুযায়ী জুন পর্যন্ত ৬০ হাজার ইএফডি মেশিন ও এসডিসি স্থাপনের কথা। সিস্টেমে ১৪ হাজার মেশিন স্থাপনের তথ্য থাকলেও মেশিন বসেছে মাত্র ১১ হাজার। মেশিন রিয়েল টাইম ডেটা প্রদর্শন করে না। ড্যাশবোর্ড ইউজারফ্রেন্ডলি নয়। মেশিন তদারকিতে কর্মকর্তাদের দেয়া হয়নি প্রশিক্ষণ। করদাতাদেরও প্রশিক্ষণ দেয়া হয়নি। মেশিন শূন্য চালান দেখালেও কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। অনিয়মের তথ্য ভ্যাট কমিশনারেটকে দেয়া হয়নি। ইউজার ম্যানুয়াল তৈরি হয়নি। কার্ডে পেমেন্টের অপশন নেই। রিটার্ন মডিউল তৈরি হয়নি। সার্ভারের সংযোগ নিয়মিত রাখার ক্ষেত্রে নেটওয়ার্ক সমস্যা। শুধু তাই নয়, আর বহু অনিয়ম ও জালিয়াতি। মেশিন বিকল হলে লোকজন আসে না। মনিটরিং নেই। এসডিসি স্থাপনের তথ্যে গরমিল। কলসেন্টারে জবাব দিতে পারে না। প্রতিষ্ঠানের তালিকা দিলেও মেশিন বসানো হয়নি। মেশিনের কনফিগারেশনে সমস্যা।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সিস্টেম তদারকির জন্য এনবিআরের কর্মকর্তাদের দেশে-বিদেশে প্রশিক্ষণ এবং ডিভাইস ব্যবহারকারীদের জন্য স্থানীয় প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা দেয়ার শর্ত ছিল। কিন্তু শিডিউল অনুযায়ী কাঠামোগত প্রশিক্ষণ প্রদান করেনি জেনেক্স। ভবিষ্যৎ প্রশিক্ষণের জন্য রেকর্ডেড টিউটোরিয়াল সরবরাহ করার শর্ত থাকলেও তা পায়নি তদন্ত কমিটি। মেশিনের ব্যবহার নিশ্চিত করতে ‘ট্যাক্সপেয়ারদের’ প্রশিক্ষণ দেয়ার কথা থাকলেও প্রশিক্ষণের কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি।
চুক্তির শর্তানুযায়ী, পাঁচজনকে চীন বা দুবাইতে ফ্যাক্টরি ভিজিট বা অভিজ্ঞতা বিনিময়, ডিভাইসের ওপর হাতে-কলমে প্রশিক্ষণ দেয়ার কথা, কিন্তু তা দেয়া হয়নি। ২০ জনকে সূচি অনুযায়ী স্থানীয় কারিগরি প্রশিক্ষণ দেয়ার কথা থাকলেও তা দেয়া হয়নি। প্রত্যেক ডিভাইস ব্যবহারকারীদের ছয় ঘণ্টা করে তিন দিন করে ব্যাচ অনুযায়ী প্রশিক্ষণ দেয়ার কথা থাকলেও তার কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। তবে প্রতিষ্ঠানের দাবি, তারা মেশিন স্থাপনের সময় ব্যবহারকারীকে মেশিন পরিচালনার প্রায়োগিক জ্ঞান প্রদান করেছে।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, মানবসম্পদ পদায়নসহ ‘স্মার্ট’ কার্য সম্পাদন পরিকল্পনা প্রণয়ন ইএফডি বা এসডিসি স্থাপিত মেশিন রাজস্ব আদায়ে অনিয়ম বিষয়ে তথ্য সংগ্রহের জন্য ‘ভিজিলেন্স প্ল্যান’ তৈরি করার শর্ত ছিল। কিন্তু প্রতিষ্ঠান মানবসম্পদ পদায়নের যে তথ্য প্রদান করেছে, তাতে দেখা গেছে, প্রতিষ্ঠানের নিয়োগকৃত জনবল ১৪৪ জন। এর মধ্যে চট্টগ্রাম আঞ্চলিক কার্যালয়ে ৩১ জন ও গুলশান মূল কার্যালয়ে ১০৬ জন কাজ করেন। স্থাপিত ১১ হাজার ৪১০টি ডিভাইস তদারকির জন্য ১৪৪ জন, অর্থাৎ প্রতিজন ৭৯টি তদারকির দায়িত্ব পালন করেন।
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, অফিস সময়ের পরে অর্থাৎ বিকাল ৫টার পর জেনেক্স কর্মীদের পাওয়া যায় না। কাজের ক্ষেত্রে তদারকির অভাব রয়েছে। যে জনবল রয়েছে, তাদের প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়নি। যখন কোনো মেশিন শূন্য চালান প্রদর্শন করে, তখন তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয় না। মেশিন বাড়ানোর ক্ষেত্রে স্মার্ট পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয়নি।
এছাড়া ভেন্ডর এফএকিউএস, জরিপ ও প্রতিবেদনসহ সকল দলিল তৈরি ও সংরক্ষণের ব্যবস্থা নেয়ার শর্ত থাকলেও কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। ভেন্ডর ব্যবহারকারীদের মতামত গ্রহণ ও তথ্য সরবরাহ করার জন্য ‘ওয়েব পেইজ’ তৈরির কথা থাকলেও তা তৈরি করা হয়নি।
Leave a Reply