আমাদের পুঁজিবাজার নিজস্ব প্রতিবেদক : কয়েক বছর ধরে চলমান বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দার প্রভাব পড়েছে বাংলাদেশের পুঁজিবাজারে। এমন সঙ্কটময় পরিস্থিতিতে পুঁজিবাজার একটি বছর পার করলো। গত বছর পুঁজিবাজারের সূচক খুব একটা বাড়েনি। বছরজুড়ে রাজনৈতিক অস্থিরতা, ব্যাংকিং খাতে অস্থিরতা, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে আসাসহ বিভিন্ন ইস্যুতে পুঁজিবাজারে মন্দাভাব বিরাজ করে। ফলে, প্রত্যাশা অনুযায়ী মুনাফা করতে পারেননি বিনিয়োগকারীরা। নতুন বছরে গতিশীল পুঁজিবাজার চান বিনিয়োগকারীসহ সংশ্লিষ্টরা।
তাদের প্রত্যাশা, পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্টদের সমন্বিত প্রচেষ্টায় নতুন বছরে পুঁজিবাজার ঘুরে দাঁড়াবে, হারানো পুঁজি ফিরে পাবেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হিসাববিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মো. আল-আমিন বলেন, গত বছর দেশের পুঁজিবাজার খুব একটা ভালো যায়নি। ইনডেক্স খুব একটা বাড়েনি। গত বছরের জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর মাসে কিছুটা ভালো ছিল পুঁজিবাজার। তবে, পর থেকেই রাজনৈতিক অস্থিরতা, ব্যাংকিং খাতের অস্থিরতা, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে আসাসহ বিভিন্ন ইস্যুতে পুঁজিবাজারে গত বছরজুড়ে অস্থিরতা বিরাজ করে। ফলে, প্রত্যাশা অনুযায়ী মুনাফা করতে পারেননি বিনিয়োগকারীরা। তবে, গত বছর বিএসইসির চেয়ারম্যান বলেছিলেন, নির্বাচনের পর পুঁজিবাজার ঘুরে দাঁড়াবে। এ প্রত্যাশা থেকে বলতে পারি যে, আসন্ন জাতীয় নির্বচনের পর সাইডলাইনে থাকা বিনিয়োগকারীরা পুনরায় বিনিয়োগে ফিরবেন। গত বছরের শেষে তিন মাস অনিশ্চয়তার কারণে বিনিয়োগকারীরা সাইডলাইনে ছিলেন। তবে, কিছু সংখ্যক শেয়ার লেনদেনের মাধ্যমে বাজার মুভমেন্ট করেছে। নতুন বছরে আমি প্রত্যাশা করি, বিএসইসি ফ্লোর প্রাইসটাকে যেন যৌক্তিকভাবে নির্ধারণ করে। বিশেষ করে, প্রাথমিক অবস্থায় নন-মার্জিন কোম্পানির শেয়ারে ফ্লোর প্রাইস আগে তুলে দেওয়া যেতে পারে। সেসব কোম্পানির শেয়ারে মার্জিন ঋণ আছে, সেক্ষেত্রে আলোচনা বা চিন্তা করে ফ্লোর প্রাইস নির্ধারণ করতে হবে। একই সঙ্গে পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্ট মার্চেন্ট ব্যাংক ও ব্রোকারেজ হাউজগুলোর প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলোচনা করে কী পরিমাণ শেয়ার ফ্লোরে ব্লক আছে, তা নির্ধারণ করে পুনর্বাসন করতে হবে। প্রয়োজনে রাষ্ট্রীয় সহযোগিতা নেওয়া যেতে পারে। এজন্য পলিসিমেকারদের সমন্বিত প্রয়াস প্রয়োজন।
তিনি আরো বলেন, বাজারে লিক্যুইডিটি বাড়ানোর চেষ্টা করতে হবে। যেসব কোম্পানির শেয়ারের দাম অস্বাভাবিকভাবে বাড়ে, বেড়ে যাওয়ার আগে স্টক এক্সচেঞ্জসহ বিএসইসিকে ব্যবস্থা নিতে হবে। প্রয়োজনে সেগুলোর ট্রেড সাসপেন্ড করতে হবে। এতে অন্য কোম্পানির শেয়ার একই প্যাটার্নে মুভ করা কমে আসবে। আমাদের পুঁজিবাজার ট্রেডনির্ভর হয়ে গেছে। এখানে ভালো কোনো ইনভেস্টর গড়ে ওঠেনি। তাই, নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে এটা বিবেচনা করতে হবে, যে ফান্ডগুলো পুঁজিবাজারে ঢুকে দ্রুত সময়ের মধ্যে বের হয়ে যায়, সেগুলো বের হওয়ার ক্ষেত্রে বিধিনিষেধ আরোপ করা হলে, তা বন্ধ হতে পারে। তাই, বাইরে ঢাকঢোল না পিটিয়ে অভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার মাধ্যমে তা ঠিক করতে হবে। সর্বোপরি, নির্বাচন পরবর্তী ট্রেড ভলিউম বাড়ানো, সবার পার্টিসিপেশন বাড়ানো, সাইডলাইনে থাকা বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগে ফেরানো এবং বাজার থেকে ফান্ড বেরিয়ে যাওয়া নিয়ন্ত্রণে রাখাতে পারলেই পুঁজিবাজারে নতুন বছরে গতিশীলতা বাড়বে বলে প্রত্যাশা করছি।
ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) শেয়ারহোল্ডার পরিচালক ও শহীদুল্লাহ সিকিউরিটিজ লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শরীফ আনোয়ার হোসেন বলেন, নতুন বছরে পুঁজিবাজার পূর্বের অবস্থানে ফিরে যাবে এবং ঘুরে দাঁড়াবে বলে আশা করছি। এখন পর্যন্ত সবকিছুই ইতিবাচক অবস্থোনে আছে। পুঁজিবাজার যে অবস্থানে চলে এসেছে, সেখান থেকে ঘুরে দাঁড়ানো ছাড়া বিকল্প নেই। বর্তমানে অধিকাংশ কোম্পানির শেয়ারের দাম ভালো অবস্থানে চলে এসেছে। আসন্ন নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সবাই অপেক্ষায় আছে। এখন সবার নজর নির্বাচনের দিকে। সেটা ভালোভাবে সম্পন্ন হলে পুঁজিবাজার ঘুরে দাঁড়িয়ে নিজস্ব গতিতে চলবে। পুঁজিবাজারে ফ্লোর প্রাইস সাময়িক একটা বিষয়। এটা তো দীর্ঘদিন বহাল থাকার কথা না। এটা প্রত্যাহার করা না হলে পুঁজিবাজারে ভালোভাবে লেনদেন করা যাবেও না। ফ্লোর প্রাইসের কারণে বিনিয়োগকারীরা শেয়ার কিনবে কি না, তা নিয়ে শঙ্কায় আছেন। কেউ কেউ ফ্লোর প্রাইস তুললে নতুন করে বিনিয়োগের অপেক্ষায় আছেন। আশা করছি, নতুন বছরে নির্বাচনের পর ফ্লোর প্রাইস তুলে নেওয়া হবে এবং পুঁজিবাজার ঘুরে দাঁড়াবে।
বাংলাদেশ পুঁজিবাজার বিনিনয়োগকারী ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক কাজী আব্দুর রাজ্জাক বলেন, বিনিয়োগকারীদের নতুন বছরের শুভেচ্ছা জানাচ্ছি। ২০২৩ সালের বেশিরভাগ সময়ই পুঁজিবাজার হতাশার মধ্যে কেটেছে। বাজার নিম্নমুখী, কোম্পানিগুলোর অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণে কাঙ্ক্ষিত লভ্যাংশ না পাওয়ায় বিনিয়োগকারীরা চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। নতুন বছরে আমরা দুর্নীতিমুক্ত স্মার্ট পুঁজিবাজার প্রত্যাশা করি। বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসির) পুঁজিবাজারের উন্নয়নের জন্য বিগত বছরে নিরলসভাবে কাজ করে যেসব সিদ্ধান্ত নিয়েছে, সেগুলোর সুফল নতুন বছরে আমরা পাবো। নতুন বছরে নতুন দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ বাড়ানো, ভালো মানের নতুন নতুন কোম্পানি তালিকাভুক্ত হওয়া এবং যেসব কোম্পানির শেয়ার ফ্লোর প্রাইসে পড়ে আছে, সেগুলোকে উঠিয়ে আনতে পারলেই পুঁজিবাজার ঘুরে দাঁড়াবে বলে প্রত্যাশা করছি।
এনবিএল সিকিউরিটিজ লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক জোবায়েদ আল মামুন হাসান বলেন, পুঁজিবাজার সূচক সব সময় অর্থনীতির নেতৃস্থানীয় সূচক হিসেবে চিহ্নিত হয়। আশা করি, অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের পাশাপাশি পুঁজিবাজার ২০২৪ সালে আমাদের সমৃদ্ধির দিকে নিয়ে যাবে। আগামী দিনে পুঁজিবাজারের উন্নয়নে আমাদের সবাইকে নিজ নিজ ক্ষেত্রে আরো সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে হবে।
Leave a Reply